হিমবাহ সম্পর্কে গুরুত্বপুর্ন কিছু তথ্য
হিমবাহের পরিচয়পর্বঃ
নদীর মত হিমবাহও একপ্রকার প্রাকৃতিক শক্তি । অনেক ভূগোলবিদ হিমবাহকে “বরফের নদী” রূপে অভিহিত করেছেন । তবে নদীর মত হিমবাহকে সব জায়গায় দেখা যায় না । খুব উঁচু পরবতের চুরায় বা মেরু অঞ্চলে হিমবাহ দেখা যায় । কিন্তু একসময় ছিল যখন পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলই হিমবাহ দ্বারা ঢাকা ছিল । সেই সময় এখন থেকে প্রায় ৫০ লক্ষ বছর আগেকার ঘটনা । এইরকম হিমযুগ পৃথিবীতে অনেকবারই ঘটেছে । উত্তাপ বেরে জাওয়ার ফলে হিমবাহ গলে গিয়ে উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে এবং মেরু অঞ্চলে বর্তমানে অবস্থান করছে ।বিজ্ঞানীরা মনে করেন একটি হিমযুগের পর একটি অন্তর্বর্তী হিমযুগের সূচনা হয় ।বর্তমানে আমরা এরকমই একটি অন্তর্বর্তী হিমযুগের মধ্যে বাস করছি । ভবিষ্যতে পৃথিবীতে আবার ঐরকম হিমযুগের সূচনা হতে পারে । হিমযুগের সময় হিমবাহ টার বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে ভূমিরূপের যে পরিবর্তন ঘটিয়েছিল টার চিহ্ন আমরা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে দেখতে পাই । বর্তমানে হিম্নবাহের কাজ কেবলমাত্র উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে ও মেরু অঞ্চলে ক্ষয় , বহন , ও সঞ্চয়ের মাধ্যমে দেখা যায় ।
হিমবাহ সম্পর্কে কিছু তথ্য
• হিমরেখাঃ – উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে ও মেরু অঞ্চলে যে সীমারেখার ওপরে অত্যধিক শীতলতার জন্য সারাবছরই জল জমে বরফে পরিণত হয় এবং যে সীমারেখার নিচে বরফ গলে যায় , সেই সীমারেখাকে হিমরেখা বলে । হিমরেখার ওপরে থাকে চিরতুষার ক্ষেত্র । পৃথিবীর সর্বত্র হিমরেখা একই উচ্চতায় অবস্থান করে না । নিরক্ষীয় অঞ্চলে হিমরেখা গড়ে ৫৫০০ মিটার , হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে ৪০০০ মিটার , আল্পস পর্বতে ২৭০০ মিটার এবং মেরু অঞ্চলে সমুদ্র সমতলে (০ মিটার) অবস্থান করে ।
• তুষারক্ষেত্রঃ- হিমরেখার ওপরে সর্বদায় তুষারপাত হয় । ক্রমান্বয়ে তুষারের সঞ্চয় এবং চাপের ফলে হাল্কা ও অসংবদ্ধ তুষারকনা জমাটবদ্ধ গিতে সক্ত বরফে পরিণত হয় । এরূপ বরফের আস্তরণকে তুষার ক্ষেত্র বলে ।
• হিমবাহ কিঃ- হিমরেখার ওপরে তুষার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চিত জমাত বাধা বরফ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তানে এবং সঞ্চিত বরফের চাপে অত্যন্ত ধীরগতিতে ভূমির ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে । এইরূপ ধীরগতিসম্পন্ন চলমান বিশাল বরফের স্তুপকে হিমবাহ বলে। ফ্লিন্ট এর মতে “হিমবাহ অলে এক বিশাল আকৃতির বরফের স্তুপ – যা তুষার জমাত বেঁধে তইরি হয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করছে এবং চলন্ত অবস্থায় রয়েছে বা কোন একসময় চলন্ত অবস্থায় ছিল ।
• হিমবাহের গতিঃ- হিমবাহের গতি অত্যন্ত ধীর । খালি চোখে দেখে এই গতি বোঝা যায় না । সারাদিনে হিমবাহ মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার ( আল্পস পর্বতে ৫৫ সেমি হিমালয় পর্বতে ৭ সেমি ) অগ্রসর হয় ।
• হিমানী সম্প্রপাতঃ- অনেক সময় ঢালের পার্থক্যের ফলে চলন্ত হিমবাহের কিছু অংস ভেঙ্গে প্রবলবেগে নিচে এসে পড়ে । একে হিমানী সম্প্রপাত বলে । এর ফলে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যায় ; গ্রাম , জনপদ প্রভৃতি ধংস হয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয় ।
• বার্গস্রুন্ডঃ- পর্বতের খাড়া ঢাল বেয়ে হিমবাহ নিচের দিকে নামার সময় পর্বত ও হিমবাহের মধ্যে অনেক সময় ফাঁকের সৃষ্টি হয় । এই ফাঁককে বার্গস্রুন্ড বলে ।
• ক্রিভাসঃ- পর্বতের খাড়া ঢাল বেয়ে হিমবাহ যখন নিচের দিকে নামে তখন তানের ফলে হিমবাহের গায়ে অনেক সময় ফাটলের সৃষ্টি হয় । এইরূপ ফাটলকে ক্রিভাস বলে ।
• সিরাকঃ- হিমবাহ ভেঙ্গে ফিয়ে তুষারপাতের সময় অনেকক্ষেত্রে হিমবাহের মধ্যে গভীর খাদের সৃষ্টি হয় । এই খাদের পাশে হিমবাহের অবশিষ্ট বরফ জমা হয়ে চুড়ার মত অবস্থান করে । এইরূপ চুড়াকে সিরাক বলে ।
• হিমশৈলঃ- সুমেরু অঞ্চলে গ্রিনল্যান্ড ও কুমেরু অঞ্চলে অ্যান্টার্কটিকায় হিমরেখা সমুদ্রপৃষ্ঠে অবস্থিত হওয়ায় হিমবাহ সমুদ্রে এসের পড়ে । জলের উর্ধচাপে , বায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্র স্রোতের প্রভাবে হিমবাহের কিছু অংশ ভেঙ্গে সমুদ্রে ভাসতে থাকে । এদের হিমশৈল বলে । হিমশৈলের ৮/৯ ভাগ জলের নিচের ডুবে থাকে মাত্র ১/৯ ভাগ জলের ওপরে ভেসে থাকে । তাই অনেকসময় হিমশৈলের আঘাতে জাহাজডুবি হয় । বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজ এইভাবে হিমশৈলের আঘাতে প্রথম যাত্রায় সমুদ্রে ডুবে যায় ।
হিমবাহের শ্রেণিবিভাগ
অবস্থান অনুসারে হিমবাহকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয় , যেমন – ১। পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ , ২। পর্বতের পাদদেশীয় হিমবাহ ।
১. পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ – উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে পর্বতের বিভিন্ন উপত্যকার মধ্য দিয়ে যে হিমবাহ প্রবাহিত হয় তাকে পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ বলে ।
উদাহরণ – কারাকোরাম পর্বতের সিয়াচেন ( ৭৬ কিমি ) , বিয়াফো ( ৬২ কিমি ) বলটারো ( ৫৮ কিমি ) , হিমালয়ে গঙ্গোত্রী ( ৩৯ কিমি ) , যমুনোত্রী , জেমু প্রভৃতি হিমবাহ উল্লেখযোগ্য ।
পৃথিবীর বৃহত্তম পার্বত্য হিমবাহ – আলাস্কার হাবার্ড পৃথিবীর বৃহত্তম পার্বত্য হিমবাহ ( ১২৯ কিমি দীর্ঘ , ৭ কিমি প্রশস্থ )
ভারতের বৃহত্তম হিমবাহ – কারাকোরাম পর্বতের সিয়াচেন হিমবাহ ( ৭৬ কিমি দীর্ঘ ) ভারতের বৃহত্তম পার্বত্য হিমবাহ ।
২. মহাদেশীয় হিমবাহ – সুমেরু ও কুমেরু বিরাত এলাকা জুড়ে যে বরফের স্তুপ দেখা যায় তাকে মহাদেশীয় হিমবাহ বলে ।
উদাহরণ – গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকায় মহাদেশীয় হিমবাহ দেখা যায় । অ্যান্টার্কটিকার গ্রেট রস ব্যারিয়ার মহাদেশীয় হিমবাহের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ।
নুনাটক্ – মহাদেশীয় হিমবাহের প্রান্তভাগে বরফের স্তর তত পুরু থাকে না । ফলে অনেক সময় বরফের মধ্য হত বরফমুক্ত পর্বতশিখর দ্বীপের ন্যায় অবস্থান করে । এরুপ বরফমুক্ত পর্বতশিখরকে এস্কিমো ভাসায় নুনাটক্ বলা হয় । কুমেরু অঞ্চলে মাউন্ট তাকাহি এইরুপ এক নুনাটক্ ।
পর্বতের পাদদেশীয় হিমবাহ – পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ যখন নিচে নামতে নামতে পর্বতের পাদদেশে বরাবর বিস্তৃত হয় , তখন তাকে পর্বতের পাদদেশীয় হিমবাহ বলে । বর্তমানে মেরু অঞ্চলে এরুপ হিমবাহের অবস্থান কিছু কিছু দেখা যায় ।
উদাহরণ – আলাস্কার মালাসপিনা ।
0 Comments