বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের আসল রহস্য - প্রতিটি ভূগোল পড়ুয়ার জানা দরকার

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের আসল রহস্য - প্রতিটি ভূগোল পড়ুয়ার জানা দরকার

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের আসল রহস্য - প্রতিটি ভূগোল পড়ুয়ার জানা দরকার

মিথ্যা ও অর্ধসত্য কথা বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিতে বলে বিপুল-সংখ্যক মানুষকে কিভাবে বিভ্রান্ত ও চমকিত করা যায় তার আরেকটি বড় উদাহরণ এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল । উড়ন্ত চাকির রহস্য যখন ফাঁস হয়ে আসছে , আন্তর্জাতিকভাবে একটি গা ছমছমে কাহিনীর শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে , তখন বিজ্ঞানের মোড়কে ঐ সুযোগ নিলেন চার্লস বার্লিৎস নামে এক দক্ষ স্কুবা ড্রাইভার । তার ঠাকুরদা ছিলেন বিখ্যাত বার্লিৎস ভাসা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা । তিনি নিজেও চলনসইভাবে অন্তত ৩০ টি ভাষা নাকি জানতেন । আর এই ভাষার কারিকুরি দেখিয়ে তিনি শুরু করলেন এক অতিপ্রাকৃতিক বা প্রায় অলৌকিক বর্ননা । ১৯৭৫ এ তার “দি বারমুডা ট্রায়াঙ্গল বইটি প্রকাশিত হয় এবং পাঁচ বছরের মধ্যে ২০ বার পুনর্মুদ্রণ হয় ।
আমেরিকার দক্ষিণপূর্ব উপকূল ছাড়িয়ে পশ্চিম আটলান্টিকে কিছু জায়গা জুড়ে আছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নামে এই তথাকথিত রহস্যময় ত্রিভুজটি , - যেখানে নাকি ১৯৪৫ সাল থেকে ১০০ টিরও বেশি জাহাজ ও উড়োজাহাজ রহস্যময় ভাবে হারিয়ে গেছে । ২৬ বছরে এক হাজারের বেশি মানুষ উধাও হয়েছেন বা মৃত্যুবরণ করেছেন । এদের কোনটিরই ব্যখ্যা নাকি পাওয়া যায় নি । কিছু বৈজ্ঞানিক পরিভাষার জগাখিচুড়ি করে বলা হয়েছে হয়ত বহির্বিশ্বের কোন উন্নত প্রাণী উড়ন্ত চাকি ( UFO ) র সাহায্যে আকাশে বা সমুদ্রের তলায়ও বর্তমান পৃথিবীর উপর গবেষণা করার জন্য মানুষ ও পার্থিব জিনিসপত্রকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে , কিংবা সময় ও স্থানের এক রহস্যময় মোচড় এর ফলে জাহাজ উড়োজাহাজ গুড়িয়ে যাচ্ছে ; আবার প্রাচীন সভ্যতা আটলান্টিস এ নাকি এক অতি শক্তিশালী স্ফটিক ব্যবহার করা হত , এটি যথাসম্ভব ঐ জায়গায় ডুবে গেছে এবং জাহাজগুলিকে টেনে নিচ্ছে । ইত্যাদি ইত্যাদি । এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে এক রহস্যময়তা ।
গালগল্প বলে মনে হলেও প্রায় গবেষণামূলক কাজ হিসাবে ভান করা এমন একটি বক্তব্য সারা পৃথিবী জুড়ে এমন আলোড়ন সৃষ্টি করে যে , শেষ অব্দি ১৯৭৬-৭৮ সালে আমেরিকা ও রাশিয়া যৌথ উদ্যোগে ঐ এলাকায় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালায় এবং চার্লস বার্লিৎস এর উল্লেখ করা ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ করে । এর ফলে দেখা গেল এই সমস্ত তথাকথিত বেশ কয়েকটি ঘটনারই পেছনে কোন রহস্যময়তা ছিল না , ছিল বাস্তব কিছু কারন । কখনো বা ঝড় , কখনো বা নাবিক বা পাইলটের অভিজ্ঞতার অভাব কিংবা যান্ত্রিক গোলযোগ । আমেরিকা থেকে লরেন্স ডি কুশ এর লেখা “Bermuda Triange Mystery Solved” নামক বই ও প্রকাশিত হয়েছে । তবুও এসব বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের চেয়ে রহস্যময়তা সাধারণ মানুষকে বেশি আকর্ষণ করে , - নিজে নিরাপদ অবস্থানে থেকে গা ছমছমে গাল গল্প পরতে বেশ ভালই লাগে । তাই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে অতি প্রাকৃতিক সংস্কার সম্পর্কেই বেশি মানুষ ওয়াকিবহাল ।
মিথ্যা বা অর্ধসত্য কথা কিভাবে বলা হয়েছে তার জন্য খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে , প্রতিটি তথাকথিত ঘটনার ব্যখ্যা করা এখানে সম্ভব নয় । তবু দু চারটি থেকে পুরো মিথ্যাচারের আঁচ করা যায় ।
যেমন , বার্লিৎস সাহেব বলেছেন  , এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এলাকাতেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি নিরুদ্দেশের ঘটনা ঘটে । কিন্তু এটি আদৌ তথ্যসম্মত নয় । ১৯৭৫ সালেই আমেরিকার নৌবহরে সপ্তম সীমান্তরক্ষী বাহিনী এমন নিরুদ্দিষ্ট জাজাজের একটি তালিকা প্রকাশ করে ; তাতে দেখা জায় ঐ বছর আমেরিকার ২১ টি জাহাজ নিরুদ্দিষ্ট হয়ে তার মধ্যে মাত্র চারটি হারায় বারমুডায় – অর্থাৎ শতকরা ২০ ভাগেরও কম; অধিকাংশ মোটেই নয় ।
৫ই ডিসেম্বর ১৯৪৫ , তারিখে বিকাল চারটায় নাকি ফ্লাইট – ১৯ এর ৫ টি বিমান পরিষ্কার আকাশে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এর কাছে এসে উধাও হয়ে যায় । উধাও হওয়ার আগে , উড়ন্ত বিমানবাহিনীর নেতা লেফটেন্যান্ট চার্লস টেলর এর কাছ থেকে নিচে কন্ট্রোল টাওয়ার  এর বেতার গ্রাহকে নাকি আতংকিত কথাবার্তা ধরা পরে । চার্লস বার্লিৎস লিখছেন –
টেলরঃ টাওয়ার শুনছেন ! অতি জরুরি ব্যাপার । আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি । মাটি দেখতে পাচ্ছি না ...
টাওয়ারঃ কোথায় আছেন ?
টেলর তাও জানি না। ...মনে হচ্ছে আমরা পুরোপুরি হারিয়ে গেছি...
টাওয়ারঃ পশ্চিমে এগোন।
টেলর: পশ্চিমদিক কোনটি তাই বুঝতে পারছি না । সব ওলট পালট হয়ে গেছে... অদ্ভুত । কোন দিক ঠিক করতে পারছি না ... এমনকি সমুদ্র যেমন দেখতে লাগে তেমনটিও লাগছে না... ইত্যাদি ।

তারপর খবর আসে সব কম্পাস খারাপ । এবং হঠাৎই সব বার্তা বন্ধ হয়ে গেল । প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ১৩ জনকে নিয়ে একটি উদ্ধারকারী বিমান আকাশে উড়ে যায় । কিন্তু আকস্মিকভাবে সেটিও হারিয়ে যায় । পরে আমেরিকার নৌ ও বিমানবাহিনী তন্ন তন্ন অনুসন্ধান করেও নাকি এই সব বিমান ও তার যাত্রীদের কোন হদিস করতে পারে নি । সংক্ষেপে এই হল চার্লস বার্লিৎস এর বর্ননা ।
কিন্তু নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায় বাস্তব ঘটনা সম্পূর্ণ আলাদা । ফ্লাইট – ১৯ এর সঙ্গে যেসব বিমানবন্দরের যোগাযোগ হয়েছিল তাদের লগবুক এ কোথাও টেলরের এমন বার্তা নথিবদ্ধ নেই । তবে বিমানগুলি যে ধ্বংস হয়েছিল তা সত্য । কিন্তু তা মোটেই বিকাল ৪ টায় নয় , সন্ধ্যে ৭ টার পর । আকাশও তখন মোটেই পরিষ্কার ছিল না । ঝড় উঠেছিল , সমুদ্রে উঠেছিল বিশাল বিশাল ঢেউ । টেলর ছাড়া বাকি বিমানচালকেরা ছিলেন অনভিজ্ঞ শিক্ষার্থী মাত্র । ঐ ঝড়ে টেলরও তার অবস্থান বুঝতে ভুল করেন । বাহামা দ্বীপপুঞ্জের কাছে এসে তার মনে হয়ে তিনি ফ্লোরিডা দ্বীপপুঞ্জের কাছে রয়েছেন । এর ফলে তিনি বিমানবন্দরে নামার জন্য উত্তরপুর্ব দিকে যাত্রা শুরু করলে আসলে বিমানগুলি ক্রমশ আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে উড়ে চলে এবং একসময় জ্বালানী শেষ হয়ে যাওয়ায় ঝড়ে উত্তাল মহাসাগরে ভেঙ্গে পরে । উদ্ধারকাজও শুরু হয় সঙ্গে সঙ্গে নয়- বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর । বার্লিৎস আরেকটি গা শিউরানো তথ্য দিয়েছিলেন । টেলর নাকি বেতার বার্তায় শেষ মুহূর্তে বলেছিলেন , “আমার মনে হচ্ছে ওরা এসেছে পৃথিবীর বাইরে থেকে ... আমায় অনুসরণ করো না । আসলে রেডিও লগবুকে লেখা আছে টেলর বলেছিলেন , “আমি এখন ২৩০০ ফুট ওপরে আছি । আমায় অনুসরণ করো না
এমনি ধারা অজস্র মিথ্যা আর বিকৃতি দিয়ে চার্লস বার্লিৎস গল্প সাজিয়েছেন । কিন্তু সনতারিখ , পাত্র পাত্রী খুঁটিনাটি দিয়ে এমনভাবে বর্ণনা মনে হয় যেন সত্যি । অনেকের তথাকথিত সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা বলা হয়েছে । এদের কেউ কেউ পরে জানিয়েছেন আদৌ তারা ওরকম কথা বলেননি কখনও বা নাবিকদের অতিরঞ্জিত কথার উপর ভিত্তি করেই ঘটনা সাজান হয়েছে ।
সরল বিশ্বাসী মানুষদের বিভ্রান্ত করে , কত লোক বাবাজি , অবতার  , গুরু , ইত্যাদি সেজে আধ্যাত্মিক ব্যবসা করে । চার্লস বার্লিৎস এর মত লোকেরাও এদেরই মত ব্যবসা করে – শুধু মাধ্যম কিছু আলাদা ।

Post a Comment

0 Comments