নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্টি হওয়া বিভিন্ন ভূমিরূপগুলির বর্ণনা / fluvial erosional landforms
নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্টি হওয়া বিভিন্ন ভূমিরূপগুলির বর্ণনা / fluvial erosional landforms
নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্টি হওয়া বিভিন্ন ভূমিরূপঃ- উচ্চগতিতে নদীর গতিপথের ঢাল খুব বেশি থাকে ( সাধারণভাবে
22°-35° ) । ফলে নদীর জলধারা প্রবলবেগে নিচের দিকে বয়ে চলে । এই অংশে নদীর প্রবল স্রোতের জন্য নদী উপত্যকা ভীষণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাখণ্ডগুলিকে নদী নিচের দিকে বহন করে নিয়ে যায় । তাই উচ্চগতিতে নদীর প্রধান কাজ ক্ষয় করা এবং ক্ষয়িত দ্রব্য বহন করা । এই অংশে ঢালের হঠাৎ পরিবর্তনের ফলে কিছু কিছু সঞ্চয় কাজও হয়ে থাকে । ব্যাপকভাবে ক্ষয় , বহন ও স্বল্প পরিমাণে সঞ্চয়ের ফলে উচ্চগতিতে নানাধরনের ভূমিরূপ গঠিত হয়ে থাকে । এগুলি হল –
১. I– আকৃতির উপত্যকা –
পার্বত্য অঞ্চলে প্রবল জলস্রোত ও বাহিত শিলাখণ্ডের সঙ্গে নদীখাতের ঘর্ষণের ফলে পার্শ্বক্ষয় অপেক্ষা নিম্নক্ষয় অধিক হয় । এর ফলে নদী উপত্যকা সংকীর্ণ ও গভীর হয়ে ইংরেজি ‘I’ আকৃতির আকার ধারণ করে ।
২. V-আকৃতির নদী উপত্যকা –
পার্বত্য অঞ্চলে প্রবল জলস্রোত ও শিলাখণ্ডের ঘর্ষণের সঙ্গে ভুমিক্ষয় ও ধসের ফলে নিম্নক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে সামান্য পার্শ্বক্ষয়ও ঘটে । ফলে নদী উপত্যকা অনেকটা ইংরেজি ‘V’ আকৃতির আকার ধারণ করে ।
৩. গিরিখাত –
বৃষ্টিবহুল অতি উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে নদীর নিম্নক্ষয়ের মাত্রা অত্যন্ত বেশি হওয়ায় নদী উপত্যকা সংকীর্ণ ও অতি গভীর হয় । এই ধরনের অতি গভীর ও সংকীর্ণ নদী উপত্যকাকেই গিরিখাত বলে । কোন কোন গিরিখাতের তলদেশের সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী পর্বতের চুড়ার উচ্চতার পার্থক্য প্রায় কয়েক হাজার মিটার হয় ।উদাহরণ – সাধারণত হিমালয় প্রভৃতি নবীন ভঙ্গিল পার্বত্য অঞ্চলে গিরিখাত দেখতে পাওয়া যায় । দক্ষিণ পেরুর কল্কা নদীর গিরিখাতটি হল বিশ্বের গভীরতম গিরিখাত ( সর্বাধিক গভীরতা ৪৩৭৫ মিটার ) ।
৪. ক্যানিয়ন –
মরুপ্রায় শুষ্ক অঞ্চলের অতিসংকীর্ন ও অতি গভীর গিরিখাতকে ক্যানিয়ন বলা হয় । উদাহরণ – আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো নদীর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন হল পৃথিবীর বৃহত্তম গিরিখাত । এর দৈর্ঘ্য ৪৮৩ কিমি , প্রস্থ ১২ কিমি এবং সর্বাধিক গভীরতা ১.৯ কিমি । দক্ষিণ পেরুর কল্কা নদীর গিরিখাত ( এল-ক্যানন দ্য কলকা ) হল পৃথিবীর গভীরতম গিরিখাত ।
৫. জলপ্রপাত –
নদীর প্রবাহগতির মধ্যে জলতলের প্রভেদকে জলপ্রপাত বলে । অর্থাৎ নদী তার প্রবাহপথে হঠাৎ খাড়া ঢাল বরাবর নিচে পড়লে জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয় ।
জলপ্রপাত নানা কারনে সৃষ্টি হতে পারে । যেমন –
ক. চ্যুতি -
নদীর গতিপথে হঠাৎ কোন চ্যুতির সৃষ্টি হলে খাড়া ঢালের সৃষ্টি হয় । আফ্রিকার জাম্বেসী নদীর ওপর জাম্বেসী নদীর জাম্বেসী জলপ্রপাত এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে ।
খ. লাভাপ্রবাহ -
নদীর গতিপথে কঠিন লাভাস্তর অবস্থান করলে জলতলের প্রভেদ ঘটে । ফলে জলপ্রপাত সৃষ্টি হতে পারে ।
গ. ভূ-আন্দোলোন-
ভূ-আন্দোলনের ফলে কোন স্থানে খাড়া ঢালের সৃষ্টি হতে পারে । এরুপ স্থানের মধ্য দিয়ে নদী প্রবাহিত হলে জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয় ।
ঘ. ঝুলন্ত উপত্যকা –
পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে ঝুলন্ত উপত্যকার সৃষ্টি হয় । ক্যালিফোর্নিয়ার য়োসেমিতি জলপ্রপাত এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে ।
ঙ. মালভূমির প্রান্তভাগ –
মালভূমির প্রান্তভাগের খাড়া ঢালে জলপ্রপাত সৃষ্টি হয় । বিহারের সুবর্ণরেখা নদীর উপর হুড্রু জলপ্রপাত এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে ।
চ. কঠিন ও কোমল শিলাস্তরের পাশাপাশি অবস্থান –
কঠিন ও কোমল শিলাস্তর পাশাপাশি অবস্থান করলে কোমল শিলাস্তর দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে খাড়া ঢালের সৃষ্টি হয় । আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নায়াগ্রা জলপ্রপাত এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে ।
উদাহরণ –
পৃথিবীতে প্রায় ১০০ টির মত বড় জলপ্রপাত আছে । পৃথিবীর সুন্দর জলপ্রপাতগুলির মধ্যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লরেন্স নদীর ওপর নায়াগ্রা জলপ্রপাত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জাম্বেসী নদীর উপর ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত উল্লেখযোগ্য । দক্ষিণ আমেরিকার ভেনিজুয়েলায় রিও করোনি নদীর এঞ্জেল জলপ্রপাত পৃথিবীর উচ্চতম জলপ্রপাত (৯৮০ মিটার )। ভারতের কর্নাটক রাজ্যের শরাবতী নদীর ওপর গেরসোপ্পা ও যোগ জলপ্রপাত দেশের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত ( ২৭৫ মিটার ) ।
জলপ্রপাতের পশ্চাদপসরণঃ-
নরম শিলা ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে একসময় অপসারিত হয় এবং কঠিন শিলাস্তরও ক্রমশ ক্ষয় পেতে থাকে । এরুপ অবস্থায় জলপ্রপাত পেছনের দিকে সরে যায় । একে জলপ্রপাতের পশ্চাদপসরণ বলে ।
৬. খরস্রোতঃ-
পার্বত্য অঞ্চলে কঠিন ও কোমল শিলাস্তর যদি পাশাপাশি উলম্বভাবে অবস্থান করে , তাহলে নরম শিলা দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ধাপযুক্ত প্রবল গতিসম্পন্ন জলস্রোতের সৃষ্টি করে । একে খরস্রোত বলে । খার্তুম থেকে আসোয়ান পর্যন্ত নীল নদের গতিপথে ৬ টি বিখ্যাত খরস্রোত লক্ষ্য করা যায় ।
৭. কর্তিত শৈলশিরাঃ-
পার্বত্য অঞ্চলে নদীপথের ঢাল হঠাৎ বৃদ্ধি পেলে তীব্র জলস্রোতের প্রভাবে শৈলশিরা ব্যাপকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং নদী সোজা পথে বয়ে চলে । তিস্তা , তোর্সা , মহানন্দা প্রভৃতি নদী এইভাবে শৈলশিরা কেটে প্রবাহিত হয়েছে ।
৮. আবদ্ধ অভিক্ষিপ্তাংশঃ-
পার্বত্য অঞ্চলে নদীর গতিপথে শৈলশিরার অভিক্ষিপ্তাংশ অবস্থান করলে নদী সামান্য বাক নিয়ে প্রবাহিত হয় । এরুপ অবস্থায় দূর থেকে দেখলে শৈলশিরাগুলিকে আবদ্ধ দেখা যায় এবং নদীর গতিপথ আড়াল হয়ে যায় । এরুপ অবস্থাকে আবদ্ধ অভিক্ষিপ্তাংশ বলে ।
৯. মন্থকূপ –
উচ্চগতিতে নদীর প্রবল স্রোতের টানে বাহিত শিলাখণ্ডগুলি নদীখাতের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে অগ্রসর হয় । জলপ্রপাত বা খরস্রোতের পাদদেশে জলের ব্যাপক ঘুর্ণীর ফলে এই সমস্ত শিলাখণ্ড নদীখাতে গোলাকার গর্তের সৃষ্টি করে । এই সমস্ত গর্তগুলিকে মন্থকূপ বলে ।
১০. প্রপাতকূপ –
জলপ্রপাতের জলধারা সজোরে আছড়ে পড়ার ফলে জলপ্রপাতের নিচে প্রবল জলস্রোতের আঘাত ও জলঘুর্নির সৃষ্টি হওয়ায় বুদবুদ ক্ষয়ের মাধ্যমে প্রায় গোলাকার গর্তের সৃষ্টি হয় তাকে প্রপাতকূপ বলে ।
0 Comments